মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৫ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
আমাকে ও আমার মেয়েদের কুপ্রস্তাব দেয় রাজ্জাক। কালের খবর কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গড়তে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কাজ করে যাচ্ছে। কালের খবর ঈশ্বরগঞ্জে কালভার নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ। কালের খবর চ্যালেঞ্জের মুখে দেশের অর্থনীতি। কালের খবর জুলাই-আগষ্টে শহীদদের ছাড়া আর কারো প্রতি দায়বদ্ধতা নেই। কালের খবর পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্ভাবনাময় অর্থকরী ফসল কাসাভা। কালের খবর চবি এক্স স্টুডেন্টস ক্লাব ঢাকা এর সভাপতি ব্যারিস্টার ফারুকী এবং সাধারণ সম্পাদক জিএম ফারুক স্বপন নির্বাচিত। কালের খবর মাটিরাঙ্গায় প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল সম্পন্ন। কালের খবর সীতাকুণ্ড হবে বাংলাদেশের অন্যতম মডেল উপজেলা : আনোয়ার সিদ্দিক চৌধুরী। কালের খবর মাটিরাঙ্গার গুমতিতে মহান বিজয় দিবসে বিএনপির শোভাযাত্রা ও পুষ্পস্তবক অর্পণ। কালের খবর
সাতক্ষীরায় লোনা পানিতে ‘সোনা’ নষ্ট হচ্ছে মাটির ভৌত গঠন। কালের খবর

সাতক্ষীরায় লোনা পানিতে ‘সোনা’ নষ্ট হচ্ছে মাটির ভৌত গঠন। কালের খবর

 

মিহিরুজ্জামান, সাতক্ষীরা, কালের খবর :
লোনা পানিতে সোনা ফলাতে চিংড়ি ঘের গিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার মাটির ভৌত গঠন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে মাটির উর্বরতার পাশাপাশি উৎপাদন ক্ষমতাও মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। বছরের পর বছর লোনা পানি আটকে রেখে চিংড়ি চাষের ফলে মাটির এই ক্ষতিকর পরিবর্তনে পরিবেশ ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন।
গত চার দশকে জেলার ৬০হাজার হেক্টর চাষযোগ্য জমি কমেছে। ফলবান বৃক্ষে ফল ধরছে না। উজাড় হয়ে যাচ্ছে গাছপালা। উপকূলীয় পরিবেশ হয়ে পড়ছে ভারসাম্যহীন। এতে জমি উর্বরতা হারাচ্ছে। ফসল উৎপাদনও দিন দিন কমছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি বিভাগ।
কৃষিবিদরা বলছেন,তিন ফসলি জমিতে অপরিকল্পিত চিংড়ি ঘের করছেন চাষিরা। ফলে যেসব জমিতে একসময় প্রচুর ধান,পাট ও অন্যান্য ফসল ফলত, সেখানে এখন লোনা পানির চিংড়ি ঘের। এসব চিংড়ি ঘের ফসলি জমি গ্রাস করছে। ফলে কমতে শুরু করেছে কৃষিজমি। অন্য দিকে,অবৈধ ভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ছিদ্র করে লবণ পানি প্রবেশ করাচ্ছেন চিংড়ি ঘের মালিকরা। এতে নদ-নদীও ক্ষতি গ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে। আর এসব অপকর্ম প্রশাসনের নাকের ডগায় ঘটছে। কিন্তু এটা বন্ধ করার ব্যাপারে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই বলেও অভিযোগ করেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশির দশকে সাতক্ষীরায় প্রচুর ধান,পাট ও অন্যান্য ফসল ফলত। অথচ গত চার দশকে জেলার ৬০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি লোনা পানির চিংড়ি ঘেরের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। বর্তমানে সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা,শ্যামনগর, কালিগঞ্জ সহ আশাশুনি,সদর ও তালা উপজেলায় লবণ পানি আটকে রেখে বাগদা চিংড়ি চাষ করা হয়। এসব উপজেলায় আমন ধান চাষের জন্য অধিকাংশ ঘের মালিক যথা সময়ে পানি নিষ্কাশন করতে দেয় না। এতে মাটিতে লবণাক্ততা ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন অণুজীব, জলাবদ্ধ অবস্থায় অক্সিজেনের অভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে মাটির গঠন হওয়ার জন্য যে উপযুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন তার ঘাটতি দেখা যায়। এ ছাড়া লবণাক্ত মৌলের প্রভাবে মাটির তৈরি হওয়া গঠনও ভেঙে যায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যা নুযায়ী,২০০১ সালে জেলায় চাষযোগ্য কৃষি জমি ছিল ১লাখ ৭৩ হাজার ৬০৪ হেক্টর; ২০১০-১১ সালে সেটি দাঁড়ায় ১ লাখ৭০ হাজার ৪১৯ হেক্টরে। ২০২২-২৩ সালে কৃষি জমির পরিমাণ আরও কমে দাঁড়ায় ১লাখ ৬৫ হাজার ২৪৫ হেক্টরে। অর্থাৎ দুই দশকে জেলায় প্রায় সাড়ে আট হাজার হেক্টর কৃষিজমি কমেছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের গবেষণায় জানা গেছে, ১৯৯৫ থেকে ২০১৫সালের মধ্যে দক্ষিণ বঙ্গের সাতক্ষীরা জেলা সহ আরও কয়েকটি জেলার কৃষিজমি আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। চিংড়ি চাষের জন্য নোনা পানি আনতে স্লুইসগেট ছিদ্র করে বাঁধ দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে। যার কারণে এসব এলাকায় সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা ও স্থায়ী জলাবদ্ধতা।
শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর এলাকার নুর নবী, মুন্সীগঞ্জের বেলাল হোসেন সহ আরও অনেকে জানান,চিংড়ি চাষের জন্য নদীতে বাঁধ দিয়ে
লবণাক্ত পানির প্রবাহ ঘুরিয়ে দিয়ে পুকুর ও ধানের জমিতে নেওয়া হয়। ফলে তিন ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। প্রথমত,নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। পানির প্রবাহ না থাকায় মাছ সহ জলজ প্রাণী এবং ম্যানগ্রোভ বনের বৃক্ষ অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। দ্বিতীয়ত,লবণাক্ত পানি লোকালয়ের মিঠা পানির পুকুরে ছড়িয়ে পড়ার কারণে সাধারণ মানুষের জন্য সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিচ্ছে। তৃতীয়ত,লবণাক্ত পানি ফসলি জমিতে নেওয়ার ফলে জমি তার উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে। যেটা ভবিষ্যতে খাদ্য ঘাটতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন তারা।
সাতক্ষীরার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার চেয়ারম্যান জিএম মাকসুদুল আলম জানান,তার ইউনিয়নের চার দিকে শুধুই লবণ পানির চিংড়ি ঘের। দিন দিন তা বাড়ছে। এতে ফসলি জমিও আশঙ্কা জনক হারে কমছে। যে জমিতে এক সময় ধান উৎপাদন হতো এখন তাতে লবণ পানির চিংড়ি হয়। ফলে তার ইউনিয়নের কৃষি শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়ছেন বলে দাবি করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে,জৈব পদার্থ হলো মাটির প্রাণ। জৈব পদার্থ কম থাকলে মাটির উর্বরতা কমে যায়। ফলে হ্রাস পাচ্ছে উৎপাদন। লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় এলাকার মাটিতে জলজ উদ্ভিদ নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। জৈব পদার্থের ঘাটতির ফলেও ধানের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলের মাটি এমনিতেই লবণাক্ত। তার ওপর লবণ পানি বছরের পর বছর আটকে রাখার ফলে মাটির ভৌত গুণাগুণের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। লবণ পানি আটকে রাখা জমিতে দীর্ঘ দিন কাক্সিক্ষত ফলন হবে না। তবে লবণাক্ত সহনশীল জাতের রোপা আমন ধানের চাষ করতে পারলে একই জমিতে বাগদা ও ধান উৎপাদন সম্ভব হবে। এ ছাড়া বোরো মৌসুমে ব্রিধান-৪৭ ও বিনা ধান-৮ ও ৯ জাতের লবণাক্ত সহনশীল জাতের ধান চাষ করতে হবে। এতে সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো.সাইফুল ইসলাম বলেন,অপরিকল্পিত চিংড়ি ঘের বন্ধ করতে না পারলে ফসলি জমি নষ্ট হতে থাকবে। জেলার অনেক এলাকায় জমিতে অতিরিক্ত লবণ পানি উত্তোলনের কারণে ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো-১) নির্বাহী প্রকৌশলী মো.সালাউদ্দিন বলেন,চিংড়ি চাষীরা আইন মানছেন না। তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ছিদ্র করে ঘেরে পানি তুলছেন। অথচ নদীর বাঁধের ৫০ গজের মধ্যে কোনো চিংড়ি ঘের করার কথা নয়। কিন্তু এ আইন তো মানছেনই না,উপরন্তু নদীর ক্ষতি করছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় মাঝে মধ্যে অভিযান পরিচালনা করে নদীর তলদেশে থাকা পাইপ অপসারণ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
পরিবেশবিদ অধ্যক্ষ আশেক ইলাহী বলেন,
লোনা পানির চিংড়ি ঘের ক্রমান্বয়ে সাতক্ষীরার ফসলি জমি গ্রাস করছে। যেসব জমিতে বছরে তিনটি ফসল ফলত, সেখানে এখন লবণ পানি। তিনি জানান, ১৯৮০সালের পর থেকে সাতক্ষীরার ছয়টি উপজেলার অন্তত ৬০হাজার হেক্টর ফসলি জমি চিংড়ি ঘেরে চলে গেছে। এসব চিংড়ি ঘেরের কারণে সাতক্ষীরা অঞ্চলের কৃষি শ্রমিকরাও কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। অনেকে কাজের সন্ধানে এলাকা ছেড়ে জেলার বাইরে চলে যাচ্ছেন।
সাতক্ষীরার পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সাকিবুর রহমান বাবলা জানান,নদী শাসন ব্যবস্থাকে অমান্য করে চিংড়ি ঘের মালিকরা ফসলি জমিতে লবণ পানি তুলছেন। এতে জমির শক্তি নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন বাস্তবায়ন না হওয়ায় অহরহ জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হচ্ছে।
সাতক্ষীরা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সরদার শরীফুল ইসলাম বলেন,সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য বিভাগকে অনুরোধ করা হয়েছে পরিকল্পিত উপায়ে লবণ পানির ঘের করা এবং পানি উত্তোলনের নিয়মনীতি করার জন্য। কেননা,অতিমাত্রার লবণ পানি পরিবেশের জন্য হুমকির কারণ। দ্রুত এটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ফসলি জমি সহ এলাকার গাছপালার ক্ষতি হবে।

দৈনিক কালের খবর নিয়মিত পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিন..

কালের খবর মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের একটি প্রতিষ্ঠান
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com